৫২’র ভাষা আন্দোলন
স্বৈরতান্ত্রিক ঔপনিবেশ হঠাতে গণআন্দোলনের কথা বলে।
দেশপ্রেমী মহান বীর শহীদের বুকের তাজা রক্তে কেনা মায়ের ভাষা বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার নাম অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই পূর্বপাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত ও শোষিত জনগোষ্ঠী তাদের নিজের ভাষা, মায়ের ভাষা বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য যে সংগ্রাম শুরু করেছিল, তা বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আজকের এইদিনে চুড়ান্তরূপ লাভ করেছিল। কিন্তু মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙ্গালী জাতিকে প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে হয়েছিল সুদীর্ঘ ৫টি বছর। ১৯৫৪ সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট পূর্বপাকিস্তানের প্রাদেশিক শাসনভার গ্রহন করে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের যে শতস্ফূর্ত জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল, তার ফলেই পাকিস্তান মুসলিমলীগ প্রথমবারের মতো প্রাদেশিক সরকার থেকে বিতাড়িত হয়। পূর্বপাকিস্তানের এই প্রাদেশিক যুক্তফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে একটি রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকার করে এবং একটি প্রস্তাব গ্রহন করে। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার সংবিধানে উর্দূর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। সুদীর্ঘ সংগ্রামের পর অর্জিত হয় মায়ের ভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা। বাংলা হয় আমাদের রাষ্ট্র ভাষা। ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জনগণের বিজয় সূচিত একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
১৯৪৮ সালের ২১ শে মার্চের জনসভায় এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে ঘোষণা করলেন- উর্দূ’ই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তখন বাংলার ছাত্রসমাজ তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তারপর ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি আবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন ঢাকায় এক জনসভায়- উর্দূ’ই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার প্রতিবাদে ৪ ফেব্রুয়ারি ’৫২ সালে ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট, ১১ ফেব্রুয়ারি সারা প্রদেশে আন্দোলনের প্রস্তুতি দিবস এবং ২১ ফেব্রুয়ারি গোটা প্রদেশব্যাপী ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হয়। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ২০ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ণে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে পাকিস্তান সরকার। ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ছাত্রসমাজ। পুলিশী গ্রেফতার, লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস কোন কিছুই ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে পারেনি। সেদিন ছাত্ররা পরিষদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সিদ্ধান্তে অটল থাকে এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের গেইট দিয়ে সবাই রাজপথে বের হয়ে আসে। শুরু হয় পুলিশের বেপোরোয়া গুলিবর্ষণ। রক্তরঞ্জিত দেহে ধূলোয় লুটিয়ে পড়েন শহীদ আব্দুস সালাম, আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন ও আব্দুল জব্বার সহ আরো অনেকে। তাঁদের অনমনীয় দৃঢ়তা, তীব্র প্রতিবাদ আর আত্মত্যাগের ফলেই আজ বাংলাভাষা লাভ করেছে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি লাভ করেছে।
৫২’র ২১শে ফেব্রুয়ারির আগে আমাদের ভাষা ছিল, কিন্তু মাতৃভাষা ছিল না। ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের মুখের ভাষা বাংলাভাষাকে আমাদের মাতৃভাষা করল। ২১শে ফেব্রুয়ারির আগে দেশ ছিল, কিন্তু স্বদেশ ছিল না। ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের ভূমিকে আমাদের মাতৃভূমি করল। একুশে ফেব্রুয়ারিতে মুখের ভাষার জন্য রক্তদানের মুহূর্ত থেকে আমরা মাতৃভাষা ও স্বদেশকে খুঁজে পেলাম- আমরা নিজেদের একটি জাতি হিসেবে চিনতে পারলাম, আমরা জানলাম যে আমরা গর্বিত বাঙ্গালী জাতি, বাংলা আমাদের নিজস্ব ভাষা, বাংলা আমাদের দেশ। আমরা বাংলাদেশী।
৫২’র সেই রক্তাক্ত পথ ধরে ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র স্বাধীকার আন্দোলন, ৬৯’র মহান গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন ও ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে অগ্নিঝরা দিনগুলোতে শত সহস্র লক্ষ কোটি বাংলার মুক্তিকামী ছাত্র-শিক্ষক, জনতা, কৃষক-শ্রমিক, আবাল বৃদ্ধ বনিতা সহ সর্বস্তরের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিজের অস্তিত্ব, জাতিসত্ত্বা, বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা, ঠিকানা ও পরিচয়কে রক্ষা করার জন্য। সুদীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর এই বর্বরোচিত, নিষ্ঠুর ও নির্মম গণহত্যাকারী, নারীধর্ষণকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে মুক্তিযুদ্ধে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে শোচনীয় পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য করে আমাদের প্রেরণার ভাষা আন্দোলন। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত থেকেই জন্ম নিল একটি দেশ- স্বাধীন বাংলাদেশ। ভাষার নামে নামকরণ করা হলো যে দেশ- সে আমার প্রিয় বাংলাদেশ।
পরবর্তী ৯০’র স্বৈরাচার বিরুধী ছাত্র ও গণ আন্দোলনও ভাষা আন্দোলনের সুত্রপাতেরই ধারাবাহিকতা। এক কথায় বাংলাদেশে যেকোন বিপ্লব ও গণ আন্দোলনে ৫২’র ভাষা আন্দোলনই প্রেরণা ও প্রদর্শক হয়ে কাজ করছে। তাই একটি দেশ, জাতি ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার ও ন্যায্য দাবী আদায়ে গণআন্দোলনের বিকল্প নেই। অমর- ২১শে ফেব্রুয়ারি স্বৈরতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক হঠিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণআন্দোলনের প্রেরণা যোগায়। গণ আন্দোলনের কথা বলে। ভাষা আন্দোলনের উজ্জীবিত প্রেরণা ও বিজয়ই আজ বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা পৃথিবীর অন্য যেকোনো ভাষার চেয়ে গর্বের এই জন্য যে, তা একটি রাষ্ট্রের জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশ ছাড়া এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর কোথাও নেই। আমাদের দেশই পৃথিবীর একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। এ সূত্রে আমরা বিশেষভাবে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মহান শহীদ বীর সৈনিকদের। বস্তুত, তাঁদের অবদান ও আত্মত্যাগের ফলেই যেমন রক্ষা পেয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদা, তেমনি সৃষ্টি হয়েছে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিসংগ্রামের প্রতিশ্রুতির সূচনা। মূলতঃ ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সরণি বেয়েই সূচিত হয়েছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ সহ সবকটি গণআন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের চিরদিনই বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে বাংলাদেশী জাতি ও বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী। তাঁদের সাহসী ভূমিকা ও গৌরবোজ্জ্বল আত্মত্যাগের ফলেই পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে রক্ষা পায় বাংলা ভাষার অনন্য গৌরব।
বাংলা’কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষায় উন্নীত করতে ক্যানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙ্গালী নতুন প্রজন্মের ভাষা সৈনিক রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার জন্য ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান বরাবর আবেদন জানিয়েছিলেন। এর প্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিগত ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।
বছর শেষে ঘুরে আসে ২১শে ফেব্রুয়ারি সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে। কিন্তু দেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিবেশে একুশ নতুন আবেদন নিয়ে ধরা দেয়। এই অমর শহীদ মিনারের পাদপীঠে দাঁড়িয়ে এদেশের মুক্তিকামী মানুষ প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারিতেই দুর্জয় শপথ গ্রহণ করে-
শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অঙ্গীকার, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্যহীনতা অবসানের অঙ্গীকার, স্বৈরাচার অনাচার ধ্বংসের অঙ্গীকার, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার সমূহ শতস্ফূর্ত ও সফল হউক। আমাদের বাক ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা হউক।
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর আমাদের জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি খুবই গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে। মহান ভাষা শহীদদের রক্তে রাঙ্গানো অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ইতিহাসে এক নতুন মর্যাদায় আসীন হয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি বাঙ্গালীর এ এক বিশাল অর্জন।
২১শে ফেব্রুয়ারী হউক আমাদের আজকের বাক ব্যক্তি স্বাধীনতার অঙ্গীকার। ২১শে ফেব্রুয়ারী হউক আমাদের গনতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। ২১শে ফেব্রুয়ারী হউক স্বৈরাচার তাবেদার হঠানোর অঙ্গীকার। ২১শে ফেব্রুয়ারী হউক গণ আন্দোলনের অঙ্গীকার।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো- ২১শে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভূলিতে পারি?
অমর-২১ শে
বিনম্র শ্রদ্ধায় চির অম্লান হউক।
—————-
২১শে কলাম-
শারফিন চৌধুরী রিয়াজ।
সাধারণ সম্পাদক
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা
আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক) ফাউন্ডেশন
হবিগঞ্জ জেলা শাখা।